শিরোনাম
Home / ঐতিহ্যের বিক্রমপুর / একদা বিক্রমপুরে একজন ফাটাকেস্ট ছিলো

একদা বিক্রমপুরে একজন ফাটাকেস্ট ছিলো

[ A+ ] /[ A- ]

শেখ রাসেল ফখরুদ্দীন:

সময়টা ২০০৮ সাল। আমি একটি ভারতীয় বাংলা ছবি দেখি। মিঠুন চক্রবর্তী অভিনয় ছবিটির নাম মিনিষ্টার ফাটাকেস্ট। ছবিটি দেখে আমি আপ্লুত হই। সদিচ্ছা থাকলে বা অনবরত চেষ্টা করলেই যে দেশের আমূল পরিবর্তন সম্ভব, এই ছবিটা দেখেই তা বুঝে ছিলাম। ২০০৭ সালের দিকে মুক্তি পাওয়া এই ছবিটি একটি ব্যবসা সফল ছবি। ছবিতে  নায়ক মিঠুন চক্রবর্তী অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক আতংকের নাম। অপরাধীরা তটস্থ থাকতো তার ভয়ে। ছবিতে মিঠুন চক্রবর্তীর একটি সংলাপ ছিলো “মারবো এখানে লাশ পড়বে স্মশানে”। এই সংলাপটি সবার মুৃখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিলো। এই ছবির নায়ক মিঠুন চক্রবর্তীর মত একজন ফাটাকেস্ট অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কন্ঠস্বর বিক্রমপুরে আগমণ হয়েছিলো। সেই নায়কের নাম অশোক মিত্র। তিনি মুন্সীগঞ্জের এসডিও ছিলেন।বিক্রমপুরের অকৃত্রিম সুহৃদ অশোক মিত্র।

১৩৫০ বঙ্গাব্দের কথা বিক্রমপুরে তখন দূর্ভিক্ষ চলছে । চারদিকে অনাহার আর মৃত্যু। মুন্সীগঞ্জ থেকে বদলি হবার আগের মুহূর্তে এসডিও অশোক মিত্র ঠিক করেছিলেন, মহকুমার সব ক’টা লঙ্গরখানা আর হাসপাতাল দেখে আসবেন। সাইকেলে সর্বত্র ঘূর্ণির মত ঘুরতেন তিনি। এক-এক দিন নব্বই মাইল পর্যন্ত ঘুরেছেন। অতর্কিতে হানা দেওয়ার ব্যাপারে তাঁর বেশ ‘দুর্নাম’ ছিল। ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকত সরকারি কর্মচারীরা।

অশোক মিত্র একদিন খবর পেলেন হাসপাতালগুলোতে ডাক্টারগণ ঠিক মত দায়িত্ব পালন করেন না। কাজে ফাঁকি দেন। কর্তব্যে গাফিলতির কারনে তিনি মুন্সীগঞ্জের এক ডাক্তারকে তাড়া করেন। কারণ, ডিউটির সময় পেরিয়ে গেলেও ডাক্তারবাবু তখনও হাসপাতালে আসেননি। তাঁকে লোক মারমত খবর দেওয়া হয় যে এসডিও সাহেব এসেছেন। জরুরি তলব।
দূর থেকে এসডিওকে দেখেই চিনতে পারেন  ডাক্তারবাবু। দূর থেকেই অশোক মিত্রের আগ্নিমূর্তি দেখে তার সামনে আগানোর সাহস পাননি আর। উল্টো দিকে সোজা ভো দৌড়।
তাকে পালাতে দেখে অশোক মিত্রও দৌড় দিলেন। হাতে একটা ভাঙা চেয়ারের পায়া। মুখের কথায় থামানো গেল না দেখে ছুড়ে মারলেন সেটা। রণে ভঙ্গ দিয়ে অপরাধীর মতো ডাক্তার তখন ধরা দিলেন জাঁদরেল অফিসারের কাছে। অশোক মিত্রের নামের সঙ্গে তখন ‘আইসিএস’ শব্দটি জোড়া।

মুন্সীগঞ্জ থেকে তখন শেখরনগর যেতে সময় লাগতো প্রায় তিন ঘণ্টা। আড়িয়ল বিলের ধারে এই হাসপাতালে পৌঁছে দেখেন, কুড়িজন রোগীর মধ্যে পনেরো জনেরই সারা গায়ে ভয়ানক বসন্ত । একেক জনের শরীর বেলুনের মতো ফুলে উঠেছে। তার মধ্যে এক জন মাঝরাতে মারা গেছে। গায়ে বড় বড় গুবরে মাছি ভনভন করছে। কোথাও ডাক্তার বা নার্সের চিহ্নটুকু নেই। অথচ ঘড়িতে সকাল পৌনে ন’টা। ডাক্তারকে তাড়া করা ছাড়া আর কিছুই মাথায় আসেনি সহৃদয় আইসিএসের।

১৯৪২ সালের দুর্ভিক্ষের সময়েরই বিক্রমপুরের আর একটা ঘটনা। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে চালের মণ সাড়ে তিন টাকা থেকে পাঁচ টাকায় উঠে গেল। আড়তদাররা মজুত ধান-চাল লুকোতে শুরু করেছে। মিরকাদিম এলাকার তিন-চারটে বড় বড় আড়তের খবর এল এসডিও সাহেবের কাছে। আড়তের মালিকদের মধ্যে এক জনের নাম বসন্ত মণ্ডল। ভাগ্যকুলের জমিদার বাড়ির ভাগ্নে। বিক্রমপুরের ততৎকালীন সময়ে মামাদের বিরাট প্রভাব তো ছিলই, তার সঙ্গে তিনি নিজেও ছিলেন পূর্ববঙ্গের বণিকসভার সভাপতি। সেই সময়েই অন্তত দু’কোটি টাকার মালিক ছিলেন তিনি ।

সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে ব্যবসা। চুনোপুঁটি ধাওয়া না করে রুই-কাতলাদের ধরাই ভালো। এটাই বিশ্বাস করতেন অশোক মিত্র। বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে গ্রেফতার করলেন বসন্ত মণ্ডলকে। পরানো হল হাতকড়া, কোমরে বাঁধা হল দড়ি। গঞ্জের লোকের সামনে দিয়ে হাঁটিয়ে মুন্সীগঞ্জ নিয়ে গিয়ে পোরা হল জেলে। কলকাতার খবরের কাগজেও এই গ্রেফতারের খবর ফলাও করে বেরিয়েছিল। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোন আপোষ করতেন না অশোক মিত্র। নানাবিধ কর্মকান্ডে তিনি বিক্রমপুরের জনগণের ভালোবাসার মানুষ হয়ে ওঠেছিলেন।

পাঁচ খণ্ডে প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনী ‘তিন কুড়ি দশ’-এর নাম শোনেননি এমন শিক্ষিত মানুষ কমই আছেন। আত্মকথার দ্বিতীয় পর্বে লিখছেন, “জীবনে বিশেষ কিছু কাজে লেগেছি একথা বলতে পারি না, তবে এইটুকু দাবি করতে পারি যে, অন্তত দশ হাজার ছেলেমেয়েকে আমি অকালমৃত্যু, জীর্ণতা, অঙ্গহানি ও বিকৃতি থেকে বাঁচিয়েছি। সারা কর্মজীবনে আমি অন্তত দশ-বারো হাজার ছেলেমেয়েকে বসন্তের টীকা ও কলেরার ইনজেকশন দিয়েছি।” আর এই কাজের হাতেখড়ি বিক্রমপুরেই। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কী করে ভুলিয়ে টিকা দিতে হয় তার একটা ফন্দি বার করেছিলেন। তখনকার দিনে নানা রঙের চিনির গুলি ‘লজেঞ্জুস’ পাওয়া যেত। এক পয়সায় দশটা। তারই একটি ঠোঙা পকেটে পুরে প্রাথমিক স্কুলে ঢুকে ছেলেমেয়েদের গল্প বলতে বলতে কৌশলে টিকা দিয়ে দিতেন।
তিনি তার আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘তিন কুড়ি দশ’ এর
পঞ্চম খণ্ড অসম্পূর্ণ রেখেই, ১৯৯৯-এর ৭ জুলাই প্রয়াত হন। বিক্রমপুরের অকৃত্রিম বন্ধু অশোক মিত্র’নাম বিক্রমপুরবাসীর হৃদয় মনিকোঠায় স্বর্নাক্ষরে লেখা থাকবে।

Print Friendly, PDF & Email
সংবাদটি শেয়ার করতে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*